দুজন যেন হরিহর আত্মা। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই বন্ধুত্ব। নামেও মিল দুই ফুটবলারের—শামসুন্নাহার। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব–১৫ নারী ফুটবল দলে খেলছে ‘এক জোড়া’ শামসুন্নাহার। দুজনই উঠে এসেছে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। দুজনেই এখন পড়ছে নবম শ্রেণিতে।
‘সিনিয়র’ শামসুন্নাহারের বাড়ি দক্ষিণ রানীপুর। ‘জুনিয়রে’র মুক্তাগাছা। সম্প্রতি হংকংয়ে জকি ক্লাব চার জাতি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলে দুজনই সমান আলো ছড়িয়েছে। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে সিনিয়র শামসুন্নাহার করে জোড়া গোল। জুনিয়র শামসুন্নাহার একটি। তবে ইরানের বিপক্ষে ছোট শামসুন্নাহার হ্যাটট্রিক করলেও বড়জন সেদিন গোলের দেখা পায়নি। আর শেষ ম্যাচে হংকংয়ের সঙ্গে সিনিয়র শামসুন্নাহার এক গোল করেছিল, জুনিয়র গোল করতে পারেনি। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা শামসুন্নাহার জুনিয়রের হাতেই উঠেছে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
অনুশীলনে কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন শামসুন্নাহার বলে ডাক দিলে একই সঙ্গে দুজন ফিরে তাকায়। এই নিয়ে সতীর্থেরা মজা করে প্রায়ই। কোচও অবশ্য মজা করে কখনো ‘শামসু’, কখনো ‘চামপু’ বলে ডাকেন দুজনকে!
শুরুতে শামসুন্নাহার সিনিয়রকে ডিফেন্ডার পজিশনে খেলাতেন ছোটন। তবে গত ডিসেম্বরে ঢাকায় হওয়া সাফে টুর্নামেন্টে তাকে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলিয়েছেন। অলরাউন্ডার শামসুন্নাহার সেখানেও প্রতিভার প্রমাণ রেখেছে। সাফের ফাইনালে সিনিয়রের গোলেই ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। এর আগে থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব–১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও একটি গোল করেছিল শামসুন্নাহার।
দুর্দান্ত দুটি গোলের স্মৃতি যার, সে নিজে কোন গোলটি এগিয়ে রাখবে? শামসুন্নাহারের হাসিমাখা উত্তর, ‘সাফের গোলটাই আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয়। ওই গোলেই আমরা প্রথমবারের মতো সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।’
কলসিন্দুরের আর আট-দশটা মেয়ের মতো ফুটবল খেলার শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছিল দুজন। বাবা-মা তো চাইতেনই না, প্রতিবেশীরাও চাইত না যে মেয়েরা ফুটবল খেলুক। শামসুন্নাহার সিনিয়র সেই দিনগুলোর কথা মনে করে এখনো কষ্ট পায়, ‘বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে স্কুলে খেলতে যেতাম। অনেক সময় স্কুলের ড্রেস পরে যেতাম। জার্সি আর বুট জোড়া লুকিয়ে রাখতাম ব্যাগে। এলাকার ছেলেরা দেখে বলত, তোমরা কেন ফুটবল খেলো? এগুলো তো তোমার ভাইয়েরা খেলবে। গ্রামের মানুষের সামনে ভয়ে আমরা যেতাম না। লোকজন দেখলে তাদের এড়িয়ে অন্য পাশ দিয়ে চলে যেতাম।’ তবে দিন বদলেছে এখন, ‘আগের মতো এখন আমাদের কেউ আর বিরক্ত করে না। বরং আমাদের দেখলে সবাই প্রশংসা করে।’
সিনিয়র শামসুন্নাহার জাতীয় দলের ক্যাম্পে প্রথম সুযোগ পেয়েছিল ২০১৪ সালে। কিন্তু জুনিয়র শামসুন্নাহার গত ডিসেম্বরের সাফ অনূর্ধ্ব–১৫ টুর্নামেন্টে প্রথম খেলেছে জাতীয় দলে। তবে সেবার খুব বেশি ম্যাচে খেলার সুযোগ মেলেনি। কোচ এবার হংকংয়ে ঠিকই খেলার সুযোগ দিয়েছেন। কোচের আস্থার প্রতিদান সে দিয়েছে ভালোমতোই। বঙ্গমাতা ফুটবলের আবিষ্কার দুই শামসুন্নাহার। তবে জুনিয়র শামসুন্নাহারকে দুই হাত ভরে দিয়েছে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট। ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে শামসুন্নাহার জুনিয়র জেতে গোল্ডেন বুট পুরস্কার। ২০১৫ সালে জেতে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফি। দুবারই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে টাকা ও ট্রফি নিয়েছে ছোট শামসুন্নাহার। আর সর্বশেষ সাফে জেতার পর গণভবনে ডেকে নিয়ে আরেকবার প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন অর্থ পুরস্কার। এতটুকু বয়স, অথচ ফুটবল খেলে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হয় শামসুন্নাহারের, ‘বাবা অসুস্থ। ভাই এলাকাতে লরি চালায়। খেলাধুলা করে যে টাকা পাই, সেটা সংসার খরচের জন্য তুলে দিই বাবার হাতে। বাবা ওই টাকা দিয়ে একটা গরু কিনেছেন। আর সর্বশেষ পাওয়া টাকাগুলো দিয়ে ব্যাংকে একটা হিসাব খুলে দিয়েছেন বাবা। বলেছেন, ভবিষ্যতে টাকাটা কাজে লাগবে।’
সিনিয়র শামসুন্নাহারের চুলগুলো বেশ বড়। কিন্তু জুনিয়রের চুলগুলো ছেলেদের মতো ছোট ছোট। চেহারায় আর চুলে হয়তো দুজনের মাঝে রয়েছে ভিন্নতা। কিন্তু দুজনই পরে লাল-সবুজের জার্সি। দুজনের স্বপ্নটাও যে অভিন্ন, ‘বাংলাদেশকে এশিয়ার সেরা দল হিসেবে দেখতে চাই আমরা।’